অনলাইন মার্কেটে প্রতারণার প্রভাব
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সকল ক্ষেত্রে যেমন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে, তেমনি অনলাইন মার্কেটে কেনাকাটার ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির প্রকাশ ঘটেছে। উম্মুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি মানুষের অনলাইন বাজার বা মার্কেট ব্যবস্থাপনাতেও আগ্রহের কমতি নেই। দিন যতই গড়াচ্ছে মানুষ অনলাইনে মার্কেট করার দিকে ততটাই ঝুঁকে পড়তে দেখা যাচ্ছে। অনলাইন মার্কেটে কেনাকাটায় যেমন মানুষের দোরগোড়ায় অত্যন্ত সহজলভ্য হয়েছে, তেমনি এক্ষেত্রে অনেকেই প্রতারণার শিকারও হতে দেখা যাচ্ছে। প্রিয় পাঠক, আমরা আজকের এই আর্টিকেলটির মাধ্যমে আপনাকে অনলাইন মার্কেটে প্রতারণার প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয়ার চেষ্টা করব।
পোস্ট সূচিপত্রঃ
ঘরে বসে অনলাইন কেনাকাটায় প্রবণতা
মার্কেটের ভির ও অস্থিরতা পরিহার করতে আমাদের মধ্যে অনেকেই আছি যারা ঘরে বসেই পন্য ক্রয়ে যথেষ্ট সস্তি অনুভব করে থাকি। বাহিরে না যেয়ে ঘরে বসে থেকে অনলাইনে পছন্দের পণ্য অর্ডার করে রাইডারের মাধ্যমে হাতের নাগালে পেয়ে মানুষ অনলাইনে কেনাকাটায় খুবই আনন্দিত ও এর উপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যার জন্য অনলাইন মার্কেট এজেন্সিদের দেখা যায়, তারা তাদের পন্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার লোভনীয় অফার বা সুবিধা দিয়ে থাকে। ফলে, গ্রাহকদের চাহিদানুপাতে স্থানীয় বাজারকে পরিহার করে অনলাইন মার্কেটে সুলভ মূল্যে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়তই।
অনলাইন কেনাকাটায় সকল শ্রেণীর ঝোক
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নমধ্যবিত্তরাও অনলাইন মার্কেট সাইডগুলোর উপর অনেকটাই অব্যস্ত হয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় অথবা ব্যবহারিক জিনিষপত্র ছাড়াও বিশেষ আকর্ষণীয় খাবার অর্ডার করে হাতের নাগালে পেতে আমরা অনেকেই এই ব্যবস্থার প্রতি দিন দিন ঝুঁকে পড়ছি।
আরও পড়ুনঃ ইন্টারনেট গতিতে নতুন বিশ্ব রেকর্ড
অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণার ফাঁদ
অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রে প্রতারণার ফাঁদ এখন একটি আতঙ্কের নাম। সম্প্রতি, অনলাইনে কেনা কাটায় একটি বিষয় খুবই লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সাধারণ গ্রাহকদের অর্ডারকৃত পন্যের ক্ষেত্রে সঠিক মান অনুযায়ী ডেলিভারি প্রদান না করে নিম্নমানের প্রোডাক্ট সরবরাহ করে রীতিমত ঠকাচ্ছে। অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণার ফাঁদ এখন একটি মোহোৎসবে পরিণত হয়েছে। অর্ডারকৃত পণ্য গ্রাহকের হাতে পৌঁছানো মাত্রই অর্ডারের সহিত মিল না থাকায় গ্রাহক পড়েন বিপাকে।
বাংলাদেশের ন্যায় অঞ্চলভেদে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও এ জাতীয় ভুয়া ই-কমার্স ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে মাকড়শার জালের মতো। সম্প্রতি, র স্যান্টান্ডার ব্যাংকিং কোম্পানি এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, বিগত ২০২৩ সালে অনলাইন প্লাটফর্মে বেছা-কেনায় জালিয়াতির পরিমান গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১.৩ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক উক্ত ব্যাংকটি এইও জানিয়েছে যে, ২০২৩ সালে বেচাকেনার ৮০ শতাংশই সম্পন্ন হয় অনলাইন মার্কেটপ্লেসে। জালিয়াত চক্ররা বিভিন্ন প্রকার আকর্ষণীয় পণ্য সুলভ ও কম মুল্যে বিক্রয়ের নামে নানা প্রকার প্রলোভন দেখিয়ে ভুয়া পোস্ট তৈরি করে ফেইসবুকে ছড়িয়ে দেয়। কারণ ছাড়ের নামে এসব পণ্যের প্রচারের মাধ্যমে ক্রেতাদের সহজেই বুঝানো যায়। সুতরাং, প্রতারণা থেকে বাঁচতে অনলাইন থেকে পণ্য ক্রয়ে বেশি বেশি করে সাবধানতার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনেক সময় দেখা যায়, অর্ডারকৃত পণ্য স্থানীয় মার্কেটপ্লেসের ভিন্নতার কারণে দামের মধ্যে অনেকাংশে তারতম্য দেখা দেয়। যার কারণে, সম্মানিত ক্রেতা অনলাইন মার্কেটে প্রদর্শিত পণ্যের দামের সাথে স্থানীয় মার্কেটের পন্যের দামের মিল না থাকলে সেই পণ্য অনলাইন ভিত্তিক মার্কেট প্লেস থেকে কিনতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। আবার ছবির সাথে পণ্যের মিল না থাকলেও পড়েন বিরম্বনায়।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সঠিক তদারকি না থাকায় কিছু কিছু অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এমন প্রতারণার সুযোগ নিচ্ছেন। যার ফলে, গ্রাহকদের অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে উৎসাহ দিনে দিনে কমছে এবং অনলাইন ভিত্তিক আধুনিক মার্কেট প্লেসগুলিতে শপিং করার করার প্রবনতাও কমছে। ই-কমার্সের নামে কিছু অনলাইন ভিত্তিক সাইট ওপেন করে প্রতিনিয়তই সাধারণ গ্রাহকের বিশ্বাসকে ধোঁকা দিচ্ছে একশ্রেণীর অসাধু গোষ্ঠী।
আমরা যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে থাকি, সে সকল ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ফেসবুকে পেজ ওপেন করে প্রায়শই ঠকাচ্ছেন গ্রাহকদের এবং বিপুল সংখ্যক অর্থ আত্মসাত করছে। ফেক পেজ ব্যবহার এবং পেজের অস্তিত্ব না থাকায় গ্রাহকদের অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে পড়তে হচ্ছে বিপদে। এক্ষেত্রে, কোনটি বৈধ পেজ যেমন যাচ্ছে না বুঝা এবং তাদের বিরুদ্ধে নেয়াও হচ্ছে না কোনো কার্যকরি ব্যবস্থা।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বিশেষ করে অনলাইন মার্কেটে পছন্দনীয় পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতারিত হয়েছেন এমন অনেকে অভিযোগ রয়েছে প্রায় ৮ শত। বিগত সালের চাইতে এটি প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে অনলাইনে খোলা ফেসবুক বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের পেজগুলো ফেক হলে গ্রাহকদের অভিযোগখানা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় না। এমন পরিস্থিতে ভোক্তা যদি প্রতারণার শিকার হন তাহলে ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে দায়-দায়িত্ব বহন করে না। তবে, ভোক্তা পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে যদি সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করেন তাহলে দ্রুতই এই ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করা অনেকটাই সহজ হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনের তাগিদে ভোক্তাকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে।
অনলাইন মার্কেটে প্রতারণা এড়ানোর নানান কৌশল
- প্রথমত, আপনি কোন কিছু অর্ডার করার আগে অবশ্যই পেজটি ভেরিফাইড কি-না যাচাই করুন। পেজটি কত দিন যাবত চলমান, পেজটির রিভিউ কত, পেজটির পেমেন্ট সিস্টেম ঠিক আছে কি-না যাচাই করে নিতে পারেন।
- দ্বিতীয়ত, অনলাইন মার্কেট প্লেসে বিক্রেতার অ্যাকাউন্ট যদি মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট না হয় কোন অবস্থাতেই তার সাথে লেনদেন করা যাবে না। প্রতিটি অনলাইন শপিং সেন্টারের নিজস্ব ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন (ডিবিআইডি) থাকা আবশ্যক। তবে, নানান জটিলতার কারণে অনেক উদ্যোক্তা যথাযথভাবে আবেদন করা সত্ত্বেও তা পাচ্ছেন না। যার কারণে ব্যবসায়ীর ডিবিআইডি ইনএকটিভ রয়ে যায়। যতি সচরাচর সকল অনলাইন বিক্রেতার ডিবিআইডি সচল থাকত তাহলে প্রতারণা অনেকটাই কমে আসত বলে অনেকের ধারণা।
- তৃতীয়ত, আপনার ক্রয়কৃত পণ্যের দাম স্থানীয় মার্কেটের চাইতে যদি বেশি হয় এবং যথারীতি খুঁজে পাওয়া অনলাইন সার্চের ছবি ব্যবহৃত হয়ে থাকলে তা ফেক সাইড হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
- চতুর্থত, আপনার অর্ডারকৃত পন্য যদি কুরিয়ার সার্ভিস যুগে সরবরাহ পেতে চান তবে, সেক্ষেত্রে অনলাইনের পেমেন্ট রিসিট এর সাথে পন্যের রসিদ মিলিয়ে নেওয়াটাই শ্রেয়।
- পঞ্চমত, অনলাইনে পন্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই নিরাপদ পেমেন্ট সিস্টেমকে বেঁছে নেওয়া উচিত। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মার্চেন্ট নাম্বার এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিং এর পেমেন্টে ব্যবস্থা এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
- বিক্রেতার যদি অফিসিয়াল ওয়েবসাইট না থাকে শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ সাইডের উপর নির্ভরশীল হয়ে পণ্য অর্ডার করা মোটেই সমীচীন নয়।
- অনলাইনে নিরাপদে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই বিক্রেতার প্রতিষ্ঠানটি ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য কিনা অর্থাৎ বিশ্বাসযোগ্য কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে।
- পরিশেষে, অনলাইনে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই ক্রেতার রিভিউ ও বিক্রেতার প্রোফাইল যাচাই করে দেখে নেয়া উচিৎ। যদি দেখেন বিক্রেতা খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে একাধিক স্থান থেকে পোস্ট দেন, তাহলে এক্ষেত্রে ক্রেতাকে পণ্য অর্ডারের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
প্রিয় পাঠক, আমরা আজকের এই আর্টিকেলটির মাধ্যমে অনলাইন মার্কেটে প্রতারণার প্রভাব এবং প্রতারণা এড়ানোর নানান কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পেলাম। আজকের এই আর্টিকেলটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
আলোকবর্ষ আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুণ। প্রীতিটি কমেন্ট রিভিও করা হয়।
comment url