সময় নিরূপণে চাঁদের বুকে টাইম জোন
মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এইবার একটি নতুন যাত্রার সূচনা করল, তা হোল চাঁদে টাইম জোন স্থাপনের মাধ্যমে সময় নিরূপণ করা। চাঁদের বুকে চলাচল করা নতুন এই সময়কে লুনার টাইম বা এলটিসি নামে অবহিত করা হবে। চাঁদের নতুন এই টাইম জোনের বিষয়ে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন ধারণা প্রদান করেছেন। প্রিয় পাঠক, আমরা আজকের এই আর্টিকেলটির মাধ্যমে সময় নিরূপণে চাঁদে এবার টাইম জোন সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
টাইম জোন এমন একটি উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া যা পৃথিবীর ন্যায় চাঁদেও স্থাপন করা যেতে পারে এমনটি ধারণা প্রদান করেছেন বিজ্ঞানীরা। জানা যায়, আমেরিকার হোয়াইট হাউস ইতোমধ্যে চাঁদের জন্য নতুন এক টাইম জোন তৈরির জন্য নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এই নতুন প্রযুক্তির টাইম জোনকে ডাকা হচ্ছে কো-অর্ডিনেটেড লুনার টাইম (এলটিসি) যা ভবিষ্যতে চন্দ্র অভিযান পরিচালনায় ব্যাপক সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখবে। ভবিস্যত এমন পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে মার্কিন সরকার কিছু নীতিমালা আরোপ করে গত ২ এপ্রিল, ২০২৪ মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাকে নির্দেশ দেয়, নাসা যেন আনুমানিক ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্রীয় ও পরিবহণ বিভাগের সহিত পরিকল্পনামাফিক কাজ করে লুনার টাইম (এলটিসি) প্রস্তুত করে।
নতুন টাইম জোন স্থাপনের বিষয়ে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা'র শীর্ষ যোগাযোগ ও নেভিগেশন কর্মকর্তা কেভিন কগিন্স জানান, চাঁদ আর পৃথিবীর মধ্যকার সময় কখনই এক নয়। চাঁদে স্থাপিত একটি পারমাণবিক ঘড়ি পৃথিবীর ঘড়ির চাইতে ভিন্ন গতিতে সময় গণনা করবে। নাসার এই পদক্ষেপকে মহাকাশ অন্বেষণের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত হিসেবে মনে করা হচ্ছে। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, এ উদ্যোগ মহাকাশে সহযোগিতা ও অগ্রগতির নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।
আরও পড়ুনঃ মহাকাশ গমনে ভারতীয় পর্যটক গোপীচন্দ
চাঁদের বিষয়ে চলমান অনুসন্ধান ও ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে আমেরিকা একটি আন্তর্জাতিক নীতি প্রতিষ্ঠায় দ্রুতই অগ্রসর হচ্ছে। তাদের এই আন্তর্জাতিক নীতির কারণে চাঁদ ও মহাকাশে বিদ্যমান অন্যান্য গ্রহানুর ক্ষেত্রেও একটি সমন্বিত টাইম জোন স্থাপন হবে। ফলে ধরে নেয়া যায় যে, আন্তর্জাতিক নাসা কর্তৃপক্ষ আনুমানিক ২০২৬ সালের মধ্যে চাঁদে প্রাথমিকভাবে টাইম জোন স্থাপন করার কাজটির পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারে।
পৃথিবীর সাথে সময়ের ব্যবধান থাকায় চাঁদে অবস্থানকালীন বা প্রদক্ষীণের সময় মহাকাশযানে সময়জনিত সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এ জাতীয় সমস্যার প্রধান কারণ হলো, চাঁদে টাইম জোন না থাকা। কো-অর্ডিনেটেড লুনার টাইম (এলটিসি) স্থাপিত হলে মানুষ যখন চাঁদ ছাড়াও অন্যান্য গ্রহে অভিযান চালাবে তখন স্থানীয় গ্রহের সময়, দিন ও বছরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে গবেষণা সম্পর্কিত ডেটা মিলিয়ে ভবিষ্যতে এসব অভিযান পরিচালনা করবে বিজ্ঞানীরা।
গ্রিনিচ টাইম বা জিএমটি
সাধারণত সময়ের হিসাব রাখা হয় মূলত গ্রিনিচ টাইম বা জিএমটি অনুসারে। ইংল্যান্ডের গ্রিনিচ-এ অবস্থিত রয়েল অবজারভেটরি থেকে বিশ্বব্যাপী সময় নিরূপণের জন্য এই গ্রিনিচ টাইম বা জিএমটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে, পৃথিবীর ঘূর্ণন প্রক্রিয়া অনুসারে এটির মান নির্ধারিত হয়ে থাকে। জানা যায়, ১৮৪৭ সাল থেকে প্রথম এর ব্যবহার শুরু হয়। জিএমটি ব্যবহারের দরুন প্রধানত আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি এক দেশ থেকে অন্যত্র দেশের বিমান ও জাহাজের ভ্রমণ সমন্বয়েও ব্যাপক সুফল পাওয়া গেছে। আবার গবেষণা সংক্রান্ত ও ডাটা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও জিএমটি সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
পৃথিবীর সময় চাঁদে ব্যবহারে অসুবিধার কারণ
পৃথিবীর প্রমিত সময় (জিএমটি) চাঁদে ব্যবহার করলে কালের বিবর্তনে চাঁদের সময় পৃথিবীর সময় থেকে অনেক দূরে সরে যাবে। এর কারণ হলো, চাঁদ ও পৃথিবীর মধ্যে সময়ের গতি ভিন্নতর হয়। পৃথিবীর তুলনায় চাঁদের সময় আনুমানিক ৫৮.৭ মাইক্রোসেকেন্ড গতিতে দ্রুত চলে। যার কারণ, পৃথিবীর চাইতে চাঁদে মহাকর্ষ কম হয়। সময়ের এই ব্যবধানটি অনেকের কাছে খুবই সামান্য মনে হতে পারে। তবে, উৎক্ষেপণকৃত মহাকাশযানটি ঠিক কোন মুহূর্তে অর্থাৎ কোথায় গিয়ে নামবে, কক্ষপথের কোন জায়গায় অবস্থান করবে, এমন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামান্য সময়ের ব্যবধান হলেও উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে সঠিক সময় নিরূপিত না হলে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের পরিস্থিতে পড়তে হতে পারে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা নাসা'র কর্মপরিকল্পনা
জানা যায়, আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা নাসা আগামী ২০২৬ সালের অনুষ্ঠিতব্য আর্টেমিস কর্মসূচি ও মহাকাশের অন্যান্য গ্রহের জন্য সময় নির্ধারণের প্রতি গুরুত্বারোপ করে চাঁদের বুকে টাইম জোন স্থাপনের নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করে। নাসার একটি যুগান্তকারী পরিকল্পনা হলো, পৃথিবীর সঙ্গে সৌরজগতের গ্রহ, উপগ্রহ ও মহাকাশে অবস্থিত বিভিন্ন বস্তুর সহিত সময়ের মান নির্ধারণ করা। নাসার এত কিছু করার অবশ্যই কারণ একটাই তা হলো, চাঁদের মাটিতে স্থায়ীভাবে ঘাঁটি স্থাপনের লক্ষ্যে আর্টেমিস প্রকল্প শুরু করা। তবে সম্প্রতি সফলভাবে পরিচালিত হয়েছে আর্টেমিস-১। এই আর্টেমিস-১ চালুর মধ্য দিয়ে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা হলো ২০২৬ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানো খুবই সহজ হবে।
আরও পড়ুনঃ খালি চোখে রাত্রিতে দেখা মিলল শনি গ্রহ !
তবে, চাঁদে ঘাঁটি স্থাপনের পাশাপাশি মঙ্গল গ্রহের ক্ষেত্রেও অভিযান চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে নাসা কর্তৃপক্ষের। সে জন্য চাঁদের কক্ষপথে নির্মাণ করা হবে ‘লুনার গেটওয়ে’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। গবেষণার পাশাপাশি মঙ্গল গ্রহে যাত্রা করার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহেও ভূমিকা রাখবে লুনার গেটওয়ে। বলাবাহল্য, আর্টেমিস প্রোগ্রাম কেবল নাসার প্রকল্পনাই নয়। জানা যায়, আন্তর্জাতিক এই প্রকল্পে যুক্ত রয়েছে পৃথিবীর মোট ৩৮টি দেশ। তবে, এক্ষেত্রে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা চাঁদের জন্য আলাদা টাইম জোন বানানোর এই সুদূর পরিকল্পনার উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সুতরাং, মহাকাশ বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশা, শিগ্রই চাঁদে পারমাণবিক ঘড়ি বসিয়ে মহাকাশে সময় নিরূপণের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।
প্রিয় পাঠক, আমরা আজকের এই আর্টিকেলটির মাধ্যমে সময় নিরূপণে চাঁদের বুকে টাইম জোন সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পেলাম। আজকের এই আর্টিকেলটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আলোকবর্ষ আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুণ। প্রীতিটি কমেন্ট রিভিও করা হয়।
comment url