মহাকাশের তারকারাজি হারিয়ে যাওয়ার রহস্য সম্পর্কে জানুন
পৃথিবীর বাইরে রয়েছে মহাকাশ। এই মহাকাশেই রয়েছে অজস্র তারকা বা নক্ষত্র। আর মহাকাশে বিদ্যমান এমন প্রকৃতির বস্তু রয়েছে যারা নিজেদের অভ্যন্তরে থাকা পদার্থকে জ্বালিয়ে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম এবং উজ্জ্বল আলো সৃষ্টি করে এদেরকেই নক্ষত্র বলে। আরে এই নক্ষত্র ক্রমশই দিন দিন রাতের আকাশ পরিমন্ডল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। রাতের আকাশের সৌন্দর্যমন্ডিত তারকারাজির হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কারণে আমরা প্রতিনিয়তই হতাশ হচ্ছি। প্রিয় পাঠক, আমরা আজকের এই আর্টিকেলটির মাধ্যমে মহাকাশের তারকারাজি হারিয়ে যাওয়ার রহস্য সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাবো।
পোস্ট সুচিপত্রঃ ইংরেজি 'স্টার' শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ হলো 'তারা'। স্টার শব্দটি মূলত অ্যাস্টার থেকে এসেছে। ধারণা করা হয় হিত্তিও ভাষার শব্দ শিত্তার থেকেও এর উৎপত্তি। আবার শিত্তার শব্দটির উৎপত্তিস্থল সংস্কৃত শব্দ সিতারা থেকে। সাধারণত তারকা বা নক্ষত্র বলতে মহাশূন্যে অবস্থিত অতি উজ্জ্বল এবং বৃহৎ গোলাকার বস্তুকে বুঝিয়ে থাকে। উচ্চ তাপে তারকা তার নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়ার দ্বারা ক্রমশই নিজের জ্বালানি উৎপন্ন করে থাকে। নিউক্লীয় সংযোজন থেকে সৃষ্ট তাপ ও চাপ মহাকর্ষীয় সঙ্কোচনকে যথারীতি ঠেকিয়ে রাখে। জ্বালানি শেষ হলে একটি তারার মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে নিউট্রন তারা বা কখনো কৃষ্ণ বিবরের সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুনঃ "আলোকবর্ষ" কি? কি তার পরিচয়!!
তারকারাজি হারিয়ে যাওয়ার রহস্য
পৃথিবী সৃষ্টির আদ্যপান্ত থেকে রাতের আকাশে তারাদের ঝিকিমিকি খেলা ক্রমাগত চলছেই। মহাকাশের অপরূপ সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে শোভা পাওয়া তারকা অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সুনামধন্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণায় এমনটিই ইঙ্গিত দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আলো নিঃসরণকারী ডায়োডসহ বিভিন্ন ধরনের আলোর অতিমাত্রায় ব্যবহারের দরুন রাতের আকাশকে উজ্জ্বল করছে। যার কারণে দূষিত হচ্ছে রাতের আলো। এমন পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে তাহলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে রাতের আকাশে আর তারাদের দেখা যাবে না বলেও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আমরা এখন প্রায়শই আকাশের দিকে তাকালে রীতিমতো খালি আকাশই চোখে পড়ে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক বিষয়। প্রকৃতি থেকে এখন প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে এই সুন্দর চিত্রটি। আধুনিক সভ্যতার যুগে ঝলমলে আলোকিত শহরে এলইডি বাতির ব্যবহার, রাস্তায় বৈদ্যুতিক অলোকসজ্জা, বাহ্যিক সীমাহীন আলোর ব্যবহারই এর প্রধান কারণ। অতিমাত্রায় আলোর ব্যবহারের দরুন দিন দিন মানুষের দৃষ্টিশক্তি সংকীর্ণ হওয়াসহ মানুষের স্বাস্থ্যের উপরেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এক গবেষণায় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ২০১৬ সাল থেকেই আলোক দূষণ খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেই সময়ে গবেষকরা জানান যে, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ আর রাতের আকাশে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি দেখেন না। এই ধারা চলতে থাকলে আগামী দুই দশকের মধ্যে প্রধান নক্ষত্রপুঞ্জগুলোও আর দৃশ্যমান থাকবে না।
জার্মান সেন্টার ফর জিওসায়েন্সের পদার্থবিদ ক্রিস্টোফার কাইবার জানান, আলোক দূষণ রাতের আকাশকে প্রায় ১০ শতাংশ হারে উজ্জ্বল করছে। যার কারণে মানুষের দৃষ্টিশক্তি অনেকটাই হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ আকাশের সবচাইতে উজ্জ্বল নক্ষত্রও আর খালি চোখে দেখতে পারবে না।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী মার্টিন রিস বলেন, রাতের আকাশ আমাদের পরিবেশের আবিচ্ছেদ্য অংশ। আগামী ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা যদি রাতের আকাশে তারা না দেখার সৌভাগ্য হয় তাহলে সেটি হবে বড়ই হতাশা জনক। উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা।
আরও পড়ুনঃ দুই শব্দের ছেলেদের ইসলামিক নাম অর্থসহ
তারার প্রকারভেদ
সংখ্যাভিত্তিক বা ব্যবস্থাভিত্তিক তারা সাধারণত ০৮ (আট) প্রকার। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো-
- একক তারা ব্যবস্থা
- যুগ্ম তারা ব্যবস্থা
- ত্রয়ী তারা ব্যবস্থা
- চতুর্মুখী তারা ব্যবস্থা
- পঞ্চমর্মুখী তারা ব্যবস্থা
- ষড়র্মুখী তারা ব্যবস্থা
- সপ্তমর্মুখী তারা ব্যবস্থা
- অষ্টমর্মূখী তারা ব্যবস্থা
তারার জীবন চক্র
তারার জীবনচক্র শুরু হয় সাধারণত ধ্বসে পড়া মেঘ থেকে। ধ্বসে পড়া মেঘের মধ্যে গচ্ছিত থাকে সাধারণত হাইড্রোজেন, হিলিয়ামসহ অতি সামান্য ভারী মৌল। তারার কেন্দ্রস্থল যখন যথেষ্ট মাত্রায় ঘন হয় তখন সেই কেন্দ্রের হাইড্রোজেন নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে হিলিয়ামে পরিণত হয়। তারার অভ্যন্তর ভাগ থেকে শক্তি বিকিরণ এবং পরিচালনের এক মিশ্র প্রক্রিয়ায় বহির্ভাগে নীত হয়। এই প্রক্রিয়াগুলো তারাকে ধ্বসে পড়তে দেয় না এবং উৎপাদিত শক্তি একটি নাক্ষত্রিক বায়ু তৈরি করে যা বিকিরণকে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। তারার অভ্যন্তরের হাইড্রোজেন জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে তারার মৃত্যু হয়। মৃত্যু ভরের উপর নির্ভর করতঃ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে। আবার মৃত্যু হওয়ার আগে তারাটি আরও কয়েক প্রজন্ম পার করে যার মধ্যে রয়েছে অপজাত অবস্থা। প্রত্যেক প্রজন্মে তার পূর্বের প্রজন্মের তুলনায় ভারী মৌলের পরিমাণ বেশি থেকে থাকে। তারা নিঃসঙ্গ বা একাকী থাকতে পারে। আবার দুই বা ততোধিক তারা একসাথে একটি তন্ত্র গড়ে তুলতে সক্ষম। যদি দুটি হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে একে অন্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে এবং বেশি নিকটবর্তী হলে একে অন্যের বিবর্তনকে প্রভাবান্বিত করে থাকে।
তারার বয়স নির্ধারণ
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সাধারণত তারার বর্ণালি ও গতি পর্যবেক্ষণ করে এর ভর, বয়স ও অন্যান্য অনেক ধর্মই বলে দিতে পারেন। তারাটির সর্বমোট ভরই মূলত তার বিবর্তন এবং চূড়ান্ত পরিণতি নির্ধারণ করে দেয়। অন্যান্য ধর্মগুলো নির্ণয় করা হয় বিবর্তনমূলক ইতিহাসের মাধ্যমে যার মধ্যে রয়েছে ব্যাস, ঘূর্ণন, চাপ এবং তাপমাত্রা। অনেকগুলো তারার তাপমাত্রাকে তাদের দীপন ক্ষমতার বিপরীতে একটি লেখচিত্রে স্থাপন করলে যে চিত্র পাওয়া যায় তাকে হে হের্টস্স্প্রুং-রাসেল চিত্র বলা হয়। এই চিত্রের মাধ্যমেই তারার বিবর্তনের বর্তমান দশা এবং এর বয়স নির্ণয় করা যায়। অধিকাংশ তারার বয়স সাধারণত এক কোটি থেকে একহাজার কোটির মধ্যে হয়ে থাকে। কিছু কিছু তারার বয়স ১৩,৭০ কোটির কাছাকাছি, যা অনেকটা আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বয়সের সমান হয়ে থাকে। তারার আকার যতই বৃদ্ধি পায় অর্থাৎ বড় হয় এর আয়ূকাল ততই কমতে থাকে। বৃহদকার তারার কেন্দ্রের চাপ বেশি থাকে এবং কেন্দ্রের চাপের সমতা আনয়নের জন্য এর হাইড্রোজেন দ্রুত পুড়ে শেষ হয়। আধিকাংশ বৃহদাকার তারার আয়ুষ্কাল গড়ে প্রায় দশ লক্ষ বছর হয়। তথাপি কম ভরের তারার জ্বালানি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয় বিধায় এদের আয়ুষ্কাল সাধারণত এক হাজার কোটি থেকে লক্ষ কোটি হয়ে থাকে।
সংস্কৃতিতে তারার গুরুত্ব
অতীতে সমাজ ও সংস্কৃতিতে তারা বিশেষ গুরুত্ব পেতো। ধর্ম চর্চার ক্ষেত্রেও এর ব্যাপকতা ছিল অপরিসীম। সমুদ্র যাত্রায় নাবিকরা তারার মাধ্যমে দিক নির্ণয় করতো। ঋতুর পরিবর্তনের সাথে তারার যথেষ্ট সম্পর্ক রয়েছে অতীতে মানুষ এমনটি ধারনা করতো। প্রাচীন জ্যোতিষীরা অনেকেই ধারণা করতেন যে, তারা স্বর্গীয় গোলকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ রয়েছেন এবং তারা অপরিবর্তনশীল। জ্যোতিষবিদরা তারাগুলোকে কিছু তারামণ্ডলে ভাগ করতেন এবং মণ্ডলগুলোর মাধ্যমে সূর্যের আনুমানিক অবস্থান ও গ্রহের গতি সম্বন্ধে ধারণা পেতেন। একসময় সূর্যের গতি প্রকৃতিকে ব্যবহার করে পঞ্জিকা তৈরি করা হতো যা কৃষি ক্ষেত্রে বিশেষ কাজে লাগতো। বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পঞ্জিকা হচ্ছে জর্জীয় পঞ্জিকা। এই পঞ্জিকাটি সৌরকেন্দ্রিক। সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের কোণগুলোর দ্বারা সাধারণত এই পঞ্জিকা নির্মিত হয়।
প্রিয় পাঠক, আমরা আজকের এই আর্টিকেলটির মাধ্যমে মহাকাশের তারকারাজি হারিয়ে যাওয়ার রহস্য সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পেলাম। পাশাপাশি তারকারাজির প্রকারভেদ, তারার জীবন চক্র, তারার বয়স নির্ধারণ ও সমাজ ও সংস্কৃতিতে তারা অপরিসীম গুরুত্ব সম্পর্কে জানলাম। আজকের এই আর্টিকেলটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আলোকবর্ষ আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুণ। প্রীতিটি কমেন্ট রিভিও করা হয়।
comment url