মসজিদুল আল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস মসজিদ সম্পর্কে জানুন
ইসলামের ইতিহাসের ঐতিহ্য ও স্মৃতিবিজড়িত অতিপ্রাচীনতম জেরুজালেম শহরে অবস্থিত মুসলমানদের প্রথম কিবলা ও পৃথিবীর তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ মসজিদুল আল-আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস।মুসলিম জাহানের প্রথম কিবলা বিধায় এটি মুসলমানদের প্রাণের স্পন্দন। ঐতিহাসিকভাবেই আল-আকসা মসজিদ মুসলমানদের পবিত্র স্থান। সৌদি আরবের মক্কার মসজিদুল হারাম এবং মদিনার মসজিদে নববীর পরেই মুসলমানদের কাছে পবিত্র স্থান জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ। খ্রিস্টপূর্ব ১০০৪ সালে মসজিদটি পুনঃ নির্মাণ করেন হজরত সোলায়মান (আ.)। এরপর বিভিন্ন সময়ই এর সংস্কার করা হয়। দুটি বড় ও ১০টি ছোট গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটিতে ফুটে উঠেছে নির্মাণ শিল্পের এক মনোমুগ্ধকর প্রতিচ্ছবি। বিভিন্ন সময়ে মসজিদটি সংস্কারে ব্যবহার করা হয় মার্বেল, সোনাসহ নানা ধরনের মূল্যবান ধাতু ও পাথর।
আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত: আমি বললাম, "হে আল্লাহর রাসূল! পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন মাসজিদ তৈরী করা হয়েছে? তিনি বললেন, মসজিদে হারাম। আমি বললাম, অতঃপর কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদে আকসা। আমি বললাম, উভয় মসজিদের (তৈরীর) মাঝে কত ব্যবধান ছিল? তিনি বললেন, চল্লিশ বছর। অতঃপর তোমার যেখানেই সালাতের সময় হবে, সেখানেই সালাত আদায় করে নিবে। কেননা এর মধ্যে ফযীলত নিহিত রয়েছে।" সহীহ বুখারী: খণ্ড ৮, বই ৫৫, হাদিস নংঃ ৫৮৫।
বিভিন্ন শাসকের সময় মসজিদটিতে অতিরিক্ত অংশ যোগ করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে গম্বুজ, আঙিনা, মিম্বর, মিহরাব, অভ্যন্তরীণ কাঠামো। বর্তমানে জেরুজালেম দখলদার ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মসজিদটি রয়েছে জর্ডানি/ফিলিস্তিনি নেতৃত্বাধীন ইসলামি ওয়াকফের তত্ত্বাবধানে। ঐতিহাসিক এ স্থানের সঙ্গে জড়িয়ে মুসলমানদের নানা স্মৃতি। এখানেই শুয়ে আছেন হজরত ইবরাহিম এবং মুসা (আ.) সহ অসংখ্য নবী ও রাসুল। এখানেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সব নবী-রাসুল এবং ফেরেস্তাদের নিয়ে নামাজ পড়েছিলেন। সেই জামাতের ইমাম ছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেই।
সংগৃহীতঃ প্রতীকী ছবি
''আল আকসা মসজিদের বুরাক মসজিদ। হারাম আস শরীফের দক্ষিণ-পশ্চিমস্থ কোনে এই ছোট স্থাপনাটি অবস্থিত। ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী মুহাম্মদ (সা.) ঊর্ধ্বাকাশের দিকে যাত্রার পূর্বে এখানেই বোরাককে বেঁধে রেখেছিলেন। ডান পাশের দেয়ালটি হল পশ্চিম দেয়ালের বিপরীত পার্শ্ব।''
এখান থেকেই হজরত মুহাম্মদ (সা.) বোরাকে করে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। এই মসজিদ নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হজরত আদম (আ.), হজরত সুলাইমান (আ.) এর নাম। জড়িয়ে আছে প্রায় অর্ধ জাহানের শাসক হজরত উমর (রা.), দ্য গ্রেট সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবিসহ অসংখ্য বীরের নাম। এই মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলে একজনের আমলনামায় ৫০০ রাকাত নামাজের সমপরিমাণ সওয়াব লিখা হয়। পবিত্র কোরআনের প্রায় ৭০ জায়গায় উচ্চারিত হয়েছে এ মসজিদের কথা।
নবী (সাঃ) বলেছেন "একজন লোক ঘরে নামাজ পড়লে একটি নেকি পান, তিনি ওয়াক্তিয়া মসজিদে পড়লে ২৫ গুণ, জুমা মসজিদে পড়লে ৫০০ গুণ, মসজিদে আকসায় পড়লে ৫০ হাজার গুণ, আমার মসজিদে অর্থাৎ মসজিদে নববীতে পড়লে ৫০ হাজার গুণ এবং মসজিদুল হারাম বা কাবার ঘরে পড়লে এক লাখ গুণ সওয়াব পাবেন। (ইবনে মাজা, মিশকাত) ।
মসজিদ আল-আকসাসহ অসংখ্য নবী-রাসুলের স্মৃতি বিজড়িত যার চত্বরে আজও অসংখ্য নবী-রাসুলের সমাধি বিদ্যমান। মসজিদুল আল আকসার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনেকেরই অজানা। বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রতিষ্ঠা হয় মুসলিম জাতির বাবা হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক পবিত্র কাবা নির্মাণের ৪০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর। তার নাতি বনি ইসরায়েলের প্রথম নবী হজরত ইয়াকুব (আ.) ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধ শহর জেরুজালেমে মসজিদ আল-আকসা নির্মাণ করেন। অতঃপর হজরত সুলায়মান (আ.) এ পবিত্র মসজিদ পুনর্নির্মাণ করেন। মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী মসজিদ আল-আকসার প্রথম নির্মাণের আগেই দাঁড়ানো অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন সুলাইমান (আ.)। ইসলামের আগমনের পর প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর ইন্তেকালের কয়েক বছর পর ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের অধীনে আসে।
ইসলামের প্রথম দিকে এ মসজিদটি কিছু দিনের জন্য মুসলমানদের কেবলা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। মুসলিমদের প্রথম কিবলা এই মসজিদ আল-আকসা ইহুদিদেরও প্রার্থনার কেন্দ্রস্থল। এই মসজিদ আল-আকসার দিকে ফিরেই মুসলিমরা আগে নামাজ আদায় করতেন মদিনায় হিজরতের ১৭তম মাস পর্যন্ত। অন্যদিকে ইহুদিদের কিতাবগুলোতে এই আল-আকসা নিয়ে প্রচুর বিবরণ রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরাও ধ্বংস করে দিয়েছিল এই আল-আকসা। ইতিহাসের ঘাত-প্রতিঘাতে বহুবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে এই অন্যতম পবিত্র স্থানটি। বর্তমানেও ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ইতিহাসের হাজারো সাক্ষী এই মসজিদুল আল-আকসা।
আরও পড়ুনঃ দুই শব্দের ছেলেদের ইসলামিক নাম অর্থসহ
প্রথম নির্মাণ খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে, মসজিদুল আকসা অর্থ ‘দূরবর্তী মসজিদ’। মিরাজের রাতে হজরত রাসুল (সা.) বোরাকে চড়ে মক্কা থেকে এখানে এসেছিলেন। অনেক বছর ধরে মসজিদুল আকসা বলতে পুরো এলাকাকে বোঝানো হতো এবং মসজিদকে আল-জামি আল-আকসা বলা হতো। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে বাদশাহ সুলাইমান (আ.) নির্মাণ করেন এই ‘প্রথম মসজিদ’ বা বায়তুল মুকাদ্দাস নামে চিরচেনা মসজিদ আল-আকসা।
১৫ জুলাই ১০৯৯ সাল মুসলমানদের জন্য এক বেদনাদায়ক দিন। সেদিন অযোগ্য মুসলিম শাসকদের ছত্রছায়ায় খ্রিস্টান ক্রুসেডার বাহিনী সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে। এরপরই ঘটতে থাকে হৃদয়বিদারক অসংখ্য ঘটনা। যা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বড়ই বেদনাদায়ক। খ্রিস্টানরা ১০৯৯ সালের ৭ই জুন প্রথমে জেরুজালেমে অবস্থিত ''বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আল-আকসা'' অবরোধ করে এবং ১৫ই জুলাই মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে ব্যাপক পরিবর্তন করে। অতঃপর এ পবিত্র মসজিদটি তারা তাদের উপাসনালয় বা গির্জায় পরিণত করে। বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধার হয় ২৩ই মার্চ ১১৬৯ খ্রিস্টাব্দ। ফাতেমীয় খেলাফতের রাজত্বকালে খলিফার নির্দেশে সেনাপতি হজরত সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি গভর্নর ও সেনাপ্রধান হয়ে মিসরে আগমন করেন। ২০ সেপ্টেম্বর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে রক্তক্ষয়ী সমরাভিযানের মাধ্যমে তিনি মসজিদ আল-আকসাসহ পুরো ঐতিহাসিক জেরুজালেম নগরী মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন।
২রা অক্টোবর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি ও গভর্নর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীবেশে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করেন। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি কর্তৃক বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত হওয়ার পর জেরুজালেমে দীর্ঘ প্রায় এক শতাব্দিব্যাপী মুসলমানরা খ্রিস্টানদের অত্যাচার থেকে মুক্ত ছিল। বর্তমানে ‘আল-আকসা’ মসজিদ বলতে বোঝায় কিবলি মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ ও বুরাক মসজিদ- এ তিনটির সমন্বয়; যা ‘হারাম আশ শরিফ’ এর চার দেয়ালের মধ্যেই অবস্থিত। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বর্তমান মসজিদের স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনঃ নির্মিত ও সম্প্রসারিত হয়। এই সংস্কার ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে তার ছেলে খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে শেষ হয়। ৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পরে তার উত্তরসূরি আল মাহদি এর পুনঃ নির্মাণ করেন। ১০৩৩ খ্রিস্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতেমীয় খলিফা আলি জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন যা বর্তমান অবধি টিকে রয়েছে।
সংগৃহীতঃ আল-আকসার কিবলি মসজিদের অভ্যন্তর ভাগ।
সালাহউদ্দিনের পূর্বসূরি সুলতান নুরুউদ্দিন জেনেগি ১১৬৮-৬৯ খ্রিষ্টাব্দে হাতির দাঁত ও কাঠ দিয়ে একটি নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন যা তার মৃত্যুর পর নির্মাণ সমাপ্ত হয়। নুরউদ্দিনের মিম্বর সালাহউদ্দিন মসজিদে স্থাপন করেন। দামেস্কের আইয়ুবী সুলতান আল-মুয়াজ্জাম ১২১৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনটি ফটকসহ উত্তরের বারান্দা নির্মাণ করেছিলেন।
সংগৃহীতঃ প্রতীকী ছবি
১২৭৮ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত আল-ফাখারিয়া মিনার আল-আকসা মসজিদের চারটি মিনারের মধ্যে প্রথম নির্মিত হয়। ১৩৪৫ খ্রিষ্টাব্দে আল-কামিল শামানের অধীনে মামলুকরা পূর্ব দিকে আরো দুটি সারি ও ফটক যুক্ত করেন।
উসমানীওরা ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষমতা নেওয়ার পর মসজিদের কোনো বড় পরিবর্তন করেনি তবে পুরো হারাম আল শরিফে সামগ্রিকভাবে পরিবর্তন আনা হয়। এসময় কাসিম পাশার ফোয়ারা (১৫২৭) নির্মিত হয়। রারাঞ্জ সেতু সংস্কার এবং তিনটি মুক্ত গম্বুজ নির্মিত হয়। এসকল স্থাপনা জেরুসালেম গভর্নরগণ নির্মাণ করিয়েছিলেন। সুলতানগণ মিনারের সম্প্রসারণ করেন। ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে গভর্নর সুলাইমান পাশা আল-আদিল জীর্ণ অবস্থার কারণে মসজিদ সংস্কার করেন।
সংগৃহীতঃ প্রতীকী ছবি
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূমি অবৈধভাবে দখলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় ইহুদিরাষ্ট্র ইসরায়েল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৭ সালে আরবদের সঙ্গে যুদ্ধে, আল-আকসা মসজিদ দখল করে নেয় দেশটি। এরপর থেকেই এটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে দখলদার ইসরায়েল। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর আল-আকসা পুরোপুরি বন্ধ থাকে। এমনকি ১৯৬৯ সালে পবিত্র মসজিটিতে অগ্নিসংযোগও করা হয়। এরপর নানা বিধিনিষেধ আর শর্তসাপেক্ষে সেখানে ইবাদতের সুযোগ পেতেন সাধারণ মুসল্লিরা। পরে আবারও বিভিন্ন অজুহাতে ইসরায়েলি বাহিনী আল-আকসা মসজিদ ফিলিস্তিনিদের জন্য বন্ধ করে দেয়। ২০০৩ সালে জেরুজালেমে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদের আল-আকসায় প্রবেশের অনুমতি দেয় ইসরায়েল। সংকট আরো ঘনীভূত হয়। বিভিন্ন সময় ইহুদিরা মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মুসল্লিদের ওপর হামলা চালায়।
আরও পড়ুনঃ History of Masjid-e-Ayesha
ইহুদিদের কাছে এই স্থানটি টেম্পল মাউন্ট হিসেবে পরিচিত। তাদের দাবি, এর নিচেই রয়েছে তাদের দুটি প্রাচীন মন্দির। অন্যদিকে খ্রিস্টানরাও আল-আকসা মসজিদের স্থাপনাকে তাদের পবিত্র স্থান হিসেবে দাবি করে আসছে।
সংগৃহীতঃ প্রতীকী ছবি
কুব্বাত আস সাখরা। এটি ইসলামী স্থাপত্যের সুপ্রাচীন নমুনা। মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে ইব্রাহিম (আঃ) এখানেই তার পুত্র ইসমাইল (আঃ) কে কুরবানি দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টির ২০০০ বছর পূর্বে ফেরেশতারা এই জায়গায় এসেছিলেন এবং ইসরাফিল (আঃ) কেয়ামতের সময় এখানেই শিঙ্গায় ফুঁ দেবেন। এখানে অবস্থিত সাখরা নামক পাথরের কারণে স্থানটি ধর্মীয় দিক দিয়ে গুরুত্ববহন করে।
আলোকবর্ষ আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুণ। প্রীতিটি কমেন্ট রিভিও করা হয়।
comment url